(লেখক পরিচিতি:- সুমন চট্টোপাধ্যায়, বাড়ি:- পূর্ব বর্ধমান জেলার অন্তর্গত রায়না গ্রামে। বর্তমানে বেলুড়ের রামকৃষ্ণ মিশন বিবেকানন্দ ইউনিভার্সিটিতে গণিতে স্নাতকোত্তর করছেন তিনি। বরাবরই রবীন্দ্রনাথের গানের অনুরাগী লেখক, সাথে চালিয়ে যান রবীন্দ্রচর্চাও। ২৫ বৈশাখের এই পুণ্যতিথিতে রইলো তাঁর লেখা এক বিশেষ প্রতিবেদন)
খুব কম পড়াশোনা করে কোনো বিষয় সম্বন্ধে যে কোনো ধরনের প্রবন্ধ উপস্থাপন করতে গেলে সেখানে নিজের এবং পাঠকের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করার প্রবল সম্ভাবনা থেকেই যায়। আবার, তিনি অর্থাৎ বিষয় যদি হন “রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর” তাহলে তো সে লেখা পড়ে বাঙালি পাঠকদের মুখ ফুলে বৃহৎ তাল-এ পরিণত হওয়াও কম অস্বাভাবিক নয়। এর কারণ, প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার আগে খুব তাড়াতাড়ি যত্নের সাথে সংরক্ষণের অপেক্ষায় থাকা “বাঙালি” নামক এই জাত’টির কিছু উচ্চশিক্ষিত এবং আমার মতোই অগুন্তি স্বল্প শিক্ষিত সাধারণের কাছে ক্ষণে ক্ষণে নিজেকে বাঙালি ভেবে অবাক হয়ে ওঠার জন্য অথবা, নিজের সাহিত্য-জ্ঞান জনসমক্ষে প্রমাণ করবার জন্য যে কোনো আড্ডায় বা বক্তৃতায় জোর করে টেনে এনে, হয় প্রবল প্রশংসা, না হলে, নিজের সমস্ত ব্যর্থতার একমাত্র কারণ হিসেবে চিহ্নিত করার মতন হাতে গোনা যে কয়েকটি সমুদ্রসম বিষয় এখনো বেঁচে রয়েছে, তাদের মধ্যে “রবীন্দ্রনাথ” প্রধানতম।
তাঁর বহুমুখী প্রতিভা এবং বিশ্বজনীনতাই যে তাঁকে “ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথ” থেকে “বিষয় রবীন্দ্রনাথ” -এ রূপান্তরিত করেছে, এই নিয়ে আমার কোন সন্দেহ নেই। আর খুব বেশি সন্দেহ প্রকাশের অবকাশ না পাওয়ার কারণ প্রথম লাইনেই ব্যক্ত করেছি।
আমার সাথে তাঁর প্রথম সত্যিকারের পরিচয় সেই ছোটবেলায়। আর আজ, আমার “সে” থেকে তাঁর “আমি” হয়ে ওঠার এক এবং একমাত্র কারণ তাঁর গান। ছাপা অক্ষর পড়া, সেইসব লেখা নিয়ে চিন্তা করা, নিজে কিছু লেখার চেষ্টা করার সাধু অভ্যেসগুলি বরাবরই হয়ে ওঠেনি । ফলে সেদিক দিয়ে পরিচয় পাওয়ার দরজা আমি নিজেই বন্ধ করেছিলাম। খুব ছোটবেলায়, প্রায় সবার ঘরের দেওয়ালেই যত্ন করে টাঙানো অদ্ভুত পোশাক পরা এই বুড়োটির ছবি দেখে গাঁয়ের “কমন” পূর্বপুরুষ মনে করে নিশ্চিন্ত এবং একই সঙ্গে বিস্মিত হওয়া আমাকে, কিছুদিনের মধ্যেই তার আবছা একটা পরিচয় দেওয়া হয়।
তারপর একদিন হঠাৎ “কুমার শানু”, “উদিত নারায়ণ” এর সুপার হিট হিন্দি গানে পাগলের মত হাত-পা ছুড়ে নাচা আমি , শুনে ফেলি একটা সুর—
“আমি হৃদয়ের কথা বলিতে ব্যাকুল , শুধাইল না কেহ ….. যার বাঁশরী-ধ্বনি শুনে আমি ত্যাজিলাম গেহ।” ওই বয়সে ওই কথাগুলো ভিতরে নেওয়ার সামর্থ্য বা ইচ্ছে কোনটাই ছিল না আমার তবু , শুধু সুরের টানেই বারবার শুনে দু’-একদিনের মধ্যেই মুখস্ত হয়ে গেল কথাগুলো। একটা না, এরকম একাধিক মনভোলানো সহজ সুর আমায় পুরোপুরি আচ্ছন্ন করল ওই সময়েই। তার মধ্যে কিছু লোকসংগীত কিছু বৈষ্ণব পদাবলী কীর্তন এবং অধিকাংশটাই “রবি ঠাকুরের গান”। না দীর্ঘদিন আমি অবিশ্যি সেগুলোকে শুধু গান হিসেবেই শুনেছি , ওই ফ্রেমে বাঁধানো অদ্ভুত লোকটার ছবির সাথে আমার যখন তখন-এর সঙ্গী ওই গানগুলোকে ভাগ করে নিতে সময় লেগেছে বহুকাল । তাঁর সাথে আরও বেশী করে মেলামেশা করবার আগ্রহ তৈরি করে দিয়েছে আমার আর এক পথ-প্রদর্শক আমাদের “মনদাদু” (বাড়ির কাছের এক প্রিয় মানুষ)। তাঁর কাছেই প্রথম ২৫ বৈশাখ পালন করা শেখা। সেসব কবেকার অভ্যেস এখন তুলে দিয়েছি।
তাঁর বেহালার করুন সুরেই কখনো বেজেছে “আমার সকল দুখের প্রদীপ জ্বেলে দিবস গেলে করব নিবেদন আমার ব্যথার পূজা হয়নি সমাপন । ” আবার কখনো দাদুর বেহালার সাথে সমবেত কণ্ঠে গেয়ে উঠেছি— “আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে এ জীবন পুণ্য করো …. এ জীবন পুণ্য করো দহন দানে ।” কখনো বা “ও আমার দেশের মাটি, তোমার পরে ঠেকাই মাথা।” কী ভাল যে লাগত একসাথে গাইতে …….!
তারপর সারা ছেলেবেলা জুড়ে প্রয়োজন ছাড়া গানের রবীন্দ্রনাথ ছেড়ে ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথকে অথবা তাঁর পাহাড়প্রমাণ অন্যান্য সৃষ্টির কথা জানবার আগ্রহ হয়নি খুব একটা , প্রধান কারন—অবশ্যই ওই সাধু অভ্যেসগুলো না থাকা । গানের রবীন্দ্রনাথকেই আঁকড়ে ধরতে ধরতে কখন যে তাকে “একান্ত নিজের রবীন্দ্রনাথ” করে ফেলেছি বুঝতে পারিনি। বন্ধুদের রীতিমতো চ্যালেঞ্জ দিয়ে শয়ে শয়ে রবীন্দ্রসঙ্গীত মুখস্থ বলে গেছি , সিডির দিকে না তাকিয়ে ঠিক ঠিক বলে দিয়েছি কার গাওয়া । অথচ ওই গানগুলোর এক কলিও আমি কোন ছাপা লেখা দেখে মুখস্ত করিনি, কখন যে মুখস্থ করেছি তাও জানিনা তবে মুখস্থ হয়ে গেছে, মুখস্থ করেছি ওই সুরের টানেই।
ভালোই চলছিল সব, হঠাৎই পড়াশোনা করতে চলে এলাম শহরে জেঠুর কাছে । বইয়ের তাকগুলো ঘেঁটে বুঝতে পারলাম একখান দুইখান না, তিনখান খন্ড আছে যাতে কিনা উনি যা গান লিখেছেন সব জড়ো করা আছে , নাম দিয়েছেন— “গীতবিতান”। একদিন শুনছি ” …. The answer my friend is blowin in the wind , the answer is blowing in the wind .”(Dylan) একটা স্তবক শেষ হতে না হতেই হঠাৎই শুরু করে দিলাম ” আমার এই পথ-চাওয়াতেই আনন্দ, খেলে যায় রৌদ্রছায়া বর্ষা আসে বসন্ত …” গানটা গাইতে থাকলাম সঙ্গে সঙ্গেই। মনে হচ্ছিল যেন একই ভিতের উপর আলাদা আলাদা দেখতে দুটো বাড়ি বানানো হয়েছে। এটা একবার নয় এরকম বহু “ইংজীরি” গান শুনতে শুনতে হঠাৎ করেই গেয়ে ফেলেছি তার কোন না কোন একটা গান। মনে হয়েছে আরিব্বাস এ তো একই গান । এই গানগুলি তখন আমাকে ওই “ইংজীরি” গানগুলোর থেকে কম কিছু দেয়নি, বরং নতুন করে আরও বড় আঙ্গিকে দেখতে পেয়েছি সেগুলিকে।
আরও বলি, কিন্তু এক্ষেত্রে গানগুলি হল, আমাদের বাংলার প্রায় পাঁচশত বছরের সম্পদ পদাবলী কীর্তন— বর্তমান সময়ে কীর্তন জগতের এক নক্ষত্র শ্রী সুমন ভট্টাচার্য মহাশয় এক টিভি অনুষ্ঠানে গাইছেন, “কিবা খেলত রাম, সুন্দর শ্যাম্
মোহন-মুরতি মধুর ঠাম্….।”
একইসঙ্গে গাইছেন ,
“মাঝে মাঝে তব দেখা পাই,
চিরদিন কেন পাই না।”
আরো কত কত গানের জট ছাড়িয়ে দেখিয়ে দিচ্ছেন তিনি। সবকিছু মিলেমিশে ঘেঁটে ঘুঁটে একাকার হয়ে যাচ্ছে তখন । শেষের দিকে ইমন রাগের উপর তৈরি কীর্তনাঙ্গ গান, “মরি লো মরি আমায় বাঁশিতে ডেকেছে কে….. ” গাওয়ার পর তিনি বললেন— রবীন্দ্রনাথ নিজে গুরু ধরে কীর্তন শিখেছিলেন কিনা তা বলা মুশকিল, তবে এক্ষেত্রে তিনি নিজেই একজন কীর্তনীয়ার প্রকৃত গুরু হয়ে বসে আছেন । মুগ্ধ হয়ে শুনছি সঙ্গে সঙ্গে তলিয়ে যাচ্ছি অতলে।
তাহলে শুধুই কি প্রভাবিত হয়ে লেখা গান ? উত্তর আসছে কই না তো! সমস্ত কিছু মিলিয়ে তৈরী হওয়া একেবারে নিজস্ব রবীন্দ্রনাথকেও তো শুনছি, — “পথে চলে যেতে যেতে কোথা কোন্খানে
তোমার পরশ আসে কখন কে জানে ॥
কী অচেনা কুসুমের গন্ধে,
কী গোপন আপন আনন্দে,
কোন্ পথিকের কোন্ গানে ॥ …””
যেখানে ওই নরম সহজ সুরে তিনি মৃত্যুকেও এনেছেন শেষ পর্যন্ত। ভয়াল ভয়ঙ্কর মৃত্যুকেও শিশুর মতো সহজ-সরল লাগছে তখন । আবার,—
” গোধূলি গগনে মেঘে ঢেকেছিল তারা।
আমার যা কথা ছিল হয়ে গেল সারা।।…”
যেখানে খুব অল্প কিছু সরঞ্জাম নিয়ে তিনি তৈরি করছেন অসামান্য কিছু সুর । সহজ অথচ ক্ষয়হীন, চিরকালীন।
মজার কথা হচ্ছে , এরকম কত গোধূলির মেঘে ঢাকা সন্ধ্যায় একেবারে গায়ে না লাগা ঝিরি ঝিরি বৃষ্টিতে কত সুন্দরীর মুখ দেখে থমকে গেছি , অনেককে কিছু বলেছি , অনেককে কিছুই বলে উঠতে পারিনি। অনেকের মুখও আবছা হয়ে গেছে কবে। শুধু, থেকে গেছে ওই স্মৃতিটা, সাদা জামায় লাগা চায়ের দাগের থেকেও স্পষ্ট হয়ে থেকে গেছে ওই গানটা ওই সুরটা, আর—সমস্ত কিছুর আড়ালে আমার সবটা জুড়ে থেকে গেছেন রবীন্দ্রনাথ।