বিদ্যাসাগর: ২০০ বছরের যুগমানব


      
সায়ক পন্ডা: 

ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, নাম টা কি শোনা শোনা লাগছে? হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন আমি বিদ্যাসাগরের কথাই বলছি, যাঁর সম্পর্কে রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী বলেছেন,”রত্নাকরের রামনাম উচ্চারণের ক্ষমতা ছিল না। অগত্যা ‘মরা-মরা’ বলিয়া তাঁহাকে উদ্ধার লাভ করিতে হইয়াছিল। এই পুরাতন পৌরাণিক নজিরের দোহাই দিয়া আমাদিগকেও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের নামকীর্তনে প্রবিত্ত হইতে হইবে।”

বিদ্যাসাগর, যিনি মধুসূদন দত্তের কাছে ছিলেন “করুনার সিন্ধু” আবার সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কাছে পরিচিত “বীরসিংহের সিংহশিশু” হিসেবে। তৎকালীন বঙ্গসমাজে নবজাগরণের যে নতুন সাম্রাজ্য তিনি গড়ে তুলেছিলেন তার সুফল, আজও ভোগ করে চলেছে সমগ্ৰ ভারতবাসী।

অর্থের প্রাচুর্য ছাড়া শুধুমাত্র সৎ, সাহসী এবং তেজিয়ান ব্যক্তিত্বসম্পন্ন হয়ে তিনি যেভাবে ইংরেজ সমাজের মাঝে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিলেন তা বর্তমান যুবসমাজের কাছে শিক্ষণীয় হয়ে রয়েছে। বিদ্যাসাগর একবার শিবনাথ শাস্ত্রীকে বলেছিলেন, ” ভারতবর্ষে এমন রাজা নাই যাহার নাকে এই চটি জুতা সুদ্ধ পায়ে ঠক করিয়া লাথি না মারিতে পারি।” সত্যিই তাঁর চরিত্রের তেজে ক্ষমতাশালী রাজারাও নগন্য ব্যক্তির পর্যায়ে পড়তেন, একেই হয়তো আধুনিক যুগে “Swag” বলা হয়।

২৬ শে সেপ্টেম্বর ১৮২০, মেদিনীপুর জেলার বীরসিংহ গ্রামে অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারে জন্মালেন অত্যন্ত “মূল্যবান” ঈশ্বরচন্দ্র। শুরু হলো “বিদ্যাসাগর যুগ”, যে যুগ শুরু হওয়ার কিন্তু তার কোনো শেষ নেই। অনুবীক্ষন যন্ত্র যেমন ব্যবহৃত হয় ছোটো জিনিসকে বড়ো করে দেখাবার জন্যে ঠিক তেমনি দেশের অনেক স্বঘোষিত “বৃহৎ” মহাপুরুষদের সামনে (যাদের বর্তমান যুগে সংখ্যাটা নেহাত কম নয়) বিদ্যাসাগরের জীবনচরিত এবং তাঁর কর্মকান্ড তুলে ধরলে সেই সব মহাপুরুষরা লজ্জায় মাথা নত করতে বাধ্য হবেন।

“বিশ্বকর্মা যেখানে চার কোটি বাঙালি নির্মাণ করিতেছিলেন সেখানে হঠাৎ দুই-একজন মানুষ গড়িয়া বসেন কেন” বিদ্যাসাগর সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের এই যথার্থ উক্তি মনে করিয়ে দেয় অনেককিছু। “বাংলা গদ্যের প্রথম যথার্থ শিল্পী” থেকে শুরু করে “মাতৃভক্তি”, “পরোপকারী”, “বাল্য বিবাহ রোধ”, “নারী শিক্ষার উন্নতি” , “বিধবা বিবাহ” প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে যার নাম একবাক্যে উচ্চারিত হয় তাঁর নাম হলো বিদ্যাসাগর। একাধিক উপমা দিয়েও যাকে বিশ্লেষণ করা প্রায় অসম্ভব প্রত্যেক সাহিত্য বিবেচকের কাছে।

বিদ্যাসাগরের কাছে “স্তন্যপীযূষদায়িনী গর্ভধারিণী” ভগবতী দেবী ছিলেন একমাত্র দেবী, যে দেবীর অঞ্জলি তিনি করে গেছেন সমগ্র জীবন ধরে। বাল্য বিবাহ ও বহু বিবাহ নিবারণ, বিধবা বিবাহ প্রচলন, স্ত্রী শিক্ষার প্রসারের মতো পুণ্যব্রতে নিজেকে সামিল করেছেন অত্যন্ত সাবলীল ও নিপুণ ভাবে। সমাজের তথাকথিত পিছিয়ে পড়া নারীসমাজের পরিত্রাতা হয়ে নিজেকে আবির্ভুত করেছিলেন বিদ্যাসাগর। বাংলা ভাষা জানতে ও শিখতে হলে, এবং বাংলা ভাষা ভালোবাসতে গেলে এখনো তাঁর লেখা “বর্ণপরিচয়” এর জুড়ি মেলা ভার। বাঙালির শৈশবের আবেগকে তিনি যেনো বন্দী করেছেন “বর্ণপরিচয়” এর প্রতিটি পাতায় এক অদ্ভুত যাদুমন্ত্র বলে। এছাড়াও তাঁর লেখা বিভিন্ন নীতি-উপদেশাত্মক গল্প কৈশোর মনকে নিয়ে গেছে এক অভিনব জগতে।

বাংলায় নবজাগরণ এবং নতুন যুগ এনে দেওয়ার সেতু বন্ধনকারী বিদ্যসাগরকে তাঁর সামাজিক ভূমিকা নিয়ে তৎকালীন সমাজ অনেক প্রশ্ন তুললেও বর্তমান বাঙালিসমাজ কোনোদিন কোনো প্রশ্ন তুলবেনা কারণ তিনি বাঙালির রন্ধ্রে রন্ধ্রে বইয়ে দিয়েছিলেন নবজাগরণের শীতল স্রোত। যে চোরা স্রোত প্রত্যেকটি বাঙালিকে বাঁচতে শিখিয়েছে মেরুদন্ড সোজা করে।

বিদ্যাসাগরের হৃদয় সদা সর্বদা মমতায় পরিপূর্ণ থাকতো বাঙালি মায়ের মতো। অগণিত মানুষের ভিড় লেগে থাকতো তাঁর কাছে সাহায্যের আলো দেখবার আশায়।
সবাইকে এক লহমায় আপন করে নিয়ে মেটাতেন তাদের সব আশা। বেঁধে নিতেন প্রত্যেক দুস্থকে এক অবিচ্ছেদ্য আত্মীয়তার নাগপাশে। তিনি যে ছিলেন সবার, তাই তো তাঁর সবচেয়ে বড়ো উপাধি ছিলো “দয়ার সাগর”, যে সাগরের মূল ধর্ম ছিলো মানবসেবা।

Social Sharing

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *